সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৫১টি পীঠস্থানের মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক বগুড়ার শেরপুরের মা ভবানীর মন্দির। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলংকা থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী এখানে আসেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।
বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে উপজেলারভবানীপুর গ্রামের সবুজ শ্যামলে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের এক লীলাভুমি মা ভবানী মন্দির। মন্দিরটির এক দিকে ভবানীপুর বাজার অন্য দিকে একটি উচ্চ বিদ্যালয় অবস্থিত। আর মন্দিরের চারদিক ঘিরে ছোট বড় বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে।
এই মাতৃমন্দির মহাশক্তির ৫১টি পীঠস্থানের অন্যতম। কালিকাপুরান অনুসারে দক্ষযজ্ঞে দেবী সতীর স্বামীনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। সতীর প্রাণহীন দেহ স্কন্ধে নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। সেই মহাপ্রলয় নৃত্য থেকে বিশ্ব ব্রক্ষান্ড রক্ষা কল্পে স্বয়ম্ভু বিষ্ণু সুদর্শণ চক্র দ্বারা সতীর প্রানহীণ দেহ ৫১টি খন্ডে বিভক্ত করেন। সেই সব দেহখন্ড বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পতিত হলে একান্নাটি পীঠস্থানের উদ্ভব হয়। ভবানীপুরে দেবীর বামতল্প বা বামপাজরাস্থি মতান্তরে দক্ষিন চক্ষু পতিত হয়েছিল। এই পীঠস্থানে দেবীর নাম অর্পনা (ভবানী) এবং বামন ভৈরব। প্রাচীন এই মহাতীর্থক্ষেত্রের বর্তমান মন্দির অবকাঠামো নাটোরের মহীয়সী রানী ভবানী কর্তৃক অষ্টাদশ শতাব্দী নিমির্ত হয়। জমিদার প্রথা উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত নাটোরের ছোট তরফ এস্টেট এই মন্দিরের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর সরকার নাটোরের ছোট তরফ এস্টেট অধিগ্রহন করেন এবং দেবোত্তর এই মন্দিরের ব্যয় নির্বাহের জন্য এ্যানুয়িটি নির্দারণ করেন। কিন্তু মন্দির অবকাঠামো সংস্কার ও পুনঃ নির্মাণ খাতে সরকারিভাবে কোন অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি।
নাটোরের রানী ভবানী এস্টেট কর্তৃক দেবোত্তর ১২ বিঘা জমির ওপর ওই মন্দির অবকাঠামো স্থাপিত।প্রাচীর বেষ্টিত মন্দির চত্বরের মধ্যে রয়েছে দক্ষিন মুখী মুল মন্দির, বামেশ ভৈরব শিবমন্দির, অপর তিনটি শিবমন্দির, ভোগ পাকশালা ৮০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩২ ফুট প্রস্থ নাটমন্দির ( আটচালা) দুটি অতিথিশালা, বাসুদেব মন্দির, গোপাল মন্দির নরনারায়ন সেবাঙ্গন (শ্যামাপ্রসাদ সেবা অঙ্গন) শাঁখারী পুকুর, দুটি স্নান ঘাট, বেষ্টনী প্রাচীরের বাইরে তিনটি শিবমন্দির এবং একটি পঞ্চমুন্ড আসন রয়েছে।
নাটোরের রানী ভবানী ছোট তরফ এস্টেট এবং অন্যান্য জমিদারদের পক্ষ থেকে এই মন্দির অনুকুলে প্রচুর ভু-সম্পত্তি দান করা হয়। যা বিট্রিশ আমলের সিএস রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে জমিদার প্রথা উচ্ছেদের পর তৎকালীন সরকার ১৯৫৮ সালে শ্রী শ্রী ভবানীমাতা ঠাকুরাণী ও অন্যান্য মন্দিরের নামে ১৮৬ একর সম্পত্তি বরাদ্দ করেন। এই সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় রাজশাহী বিভাগীয় রাজস্ব কর্মকর্তাকে। কিন্তু সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারন মন্দিরের নামে বরাদ্দকৃত দেবোত্তর ভু-সম্পত্তি পুকুর জলমহাল ইত্যাদি সবকিছুই ভুলবশত সরকার খাস খতিয়ানে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে বলে মন্দির কমিটি সুত্রে জানা যায়। এ ব্যাপারে র্বতমান কমিটি রেকর্ড সংশোধনের জন্য আদালতে আবেদন করেছেন এবং বর্তমানে বিষয়টি বিচারাধীন আছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র এই পীঠস্থান ও তীর্থক্ষেত্রে রামনবমী, শারদীয় দুর্গোৎসব, শ্যামা পুজা, মাঘী পুর্ণিমা, বাসন্তী দুর্গোৎসব, প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ওইসব অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি ভারত, নেপাল, ভুটানসহ অন্যান্য দেশ থেকেও প্রতি বছর হাজার হাজার পুন্যার্থী এই মন্দিরে সমবেত হন। মন্দির কমিটির অভিযোগ, নুন্যতম সুযোগ সুবিধা না থাকায় ১৯৮৮ সালে সম্পুর্ন বেসরকারি উদ্যোগে ভবানীপুর মন্দির সংস্কার উন্নয়ন ও পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। বিগত ১৪ বছরে এই কমিটি মন্দির চত্বরে বিভিন্ন সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে জনগনের দানকৃত অর্থের মাধ্যমে। মন্দির কমিটি নেতৃবৃন্দ জানান, ১৯৯৪ সালে তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী এই মন্দির পনিদর্শনে আসেন। এ সময় তিনি হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে সংস্কার কাজের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেন। তারা আরো জানান, শেরপুর-ধুনট এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯২ সালে ঘোগা বটতলা-ভবানীপুর রুটের ৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়। পরে তিনি একটি অতিথিশালা নির্মাণের জন্য আরো এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। এছাড়াও মন্দিরের উন্নয়নকল্পে তিনি একাধিক অনুদানের ব্যবস্থা করেছেন বলে তারা জানান।
পূজা অর্ঘদান বা ভোগদানঃ পুন্যার্থীদের পূজা অর্ঘদানের জন্য মন্দিরে ব্যবস্থা রয়েছে। মিষ্টান্ন ভোগের জন্য মন্দির চত্বরে মিষ্টির দোকান রয়েছে। এছাড়াও অন্ন ভোগ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্ন ভোগের সামগ্রী বেলা ১১টার মধ্যে কমিটি নিয়োজিত কেয়ারটেকারের কাছে জমা দিতে হয়।
বিরতিহীন বাসে বগুড়া শহর থেকে পনের ও অন্যান্য বাসে বারো টাকায় শেরপুর শহরে আসতে হবে। সময় লাগবে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। এরপর শেরপুর উপজেলা সদর থেকে অটোটেম্পু, রিকসা, ভ্যানসহ অন্যান্য যানবাহন যোগেমা ভবানী মন্দিরে যাওয়া যায়। তবে মাত্র ১০ টাকা ভাড়ায় টেম্পুযোগে সরাসরি মন্দিরে যাওয়া যায়। এছাড়া ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঘোগা বটতলা নেমে সেখান থেকেও রিক্সাভ্যানে মন্দিরে যাওয়া যায়।
সরকার বিভিন্ন সময় মন্দিরটির উন্নয়নের জন্য নানামুখী সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহন করেছে। তারপরও দ্রুততার সাথে মন্দিরের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরে আনা এবং দর্শনার্থীদের সকল সুযোগ সুবিধা দিতে সরাসরি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। তবে এটি দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানের পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS